বুধবার, ১০ জুন, ২০১৫

ভোর, পতিতা, অতঃপর ভালবাসা

সময়টা ২০৩৬ সাল, ৫ ফেব্রুয়ারী৷ গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল, সন্ধা ঘনিয়ে আসছে৷ উসকোখুসকো চেহারা আর ক্লান্তি নিয়ে কলেজ মাঠের পাশে পুকুর পাড় দিয়ে যাচ্ছি৷ গোসল শেষে ঘাটের সিড়ি বেয়ে ভেজা শরীরে এক পরিচিতের দেখা, কোমরের বাঁক টা এখনো সেই আগের মতই আছে, শরীর থেকে পানি ঝরছে, তবে সন্ধার মৃদু অন্ধকারেও এখন আর তার যৌবন উছলিয়ে পড়ে না. . .

মাসুম ভাইয়ের দোকানে গেলাম,
-ভাই, তিন'শ টাকা দিতে হবে, দিন দশেকের মধ্যেই দিয়ে দেব৷

সামান্য বিদ্যা নিয়ে বড় কিছুই হতে পারিনি বা আমাকে হতে দেওয়া হয়নি৷ যতসামান্য নিয়ে একটা হাইস্কুলে জুনিয়র শিক্ষক পদে কিছুদিন নিযুক্ত ছিলাম, মাস দু'য়েক হলো সেই শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছি৷ এখন পথে পথে ঘোরাটা স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে৷

টাকাটা নিয়ে সেই পরিচিতের বাড়িতে গেলাম, আমাকে দেখে সে নারী কিছুটা স্তম্ভিত৷ ঘরের দরজা লাগিয়ে দেবে এমন সময় আমার মুখে স্বর ফুটল, বললাম;
-করুনা নিতে আসিনি, আমিও তোমাকে আর পাঁচজনের মত আজ রাতের জন্য খরিদ করতে চাই. . .
বলতে গিয়ে গলাটা কেপে উঠল!

নারী যখন বলেই ফেলেছি, নামও বলে দেই, হউক তার নাম "মৃনালিনী"৷
রাত ৯টা বেজে ২৭ মিনিট৷ পশ্চিমের রুমটাতে আমরা বসে, কেউ কারো সাথে কথা বলছি না, আজ সবকিছু মনে পড়ছে, চাপানো কথাগুলো কালবৈশাখীর মত ধেয়ে আসছে. . .
খানিক বাদে বললাম,
-মৃনা, কেমন আছ? এতদিন কেমন ছিলে?

মৃনালিনীর চোখমুখে আর সেই আগের দুষ্টমি, আগের সেই যৌনতা নেই৷ চাপা সুরে মৃনালিনী বলতে লাগলো,
-অনেকদিন হলো তোমাকে দেখিনি, এইতো তোমাকে শেষ করতে গিয়ে আজ নিজেই শেষ হয়ে আছি, বাকীটা নিজ চক্ষে দেখতেছো৷ তোমাকে মিথ্যে মামলায় জেলে পাঠালাম, কিছুদিন গড়াতেই নানু ভাল চাকুরীজিবি ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিল, ভালই ছিলাম প্রথম দুই বছর, এরপর ও কোথাকার একমেয়ের পাল্লাই পড়ল৷ দিনরাত ঐ মেয়ের পিছনে টাকা উড়াতো, নেশা করে ঘরে ফিরতো৷ হঠাৎ একদিন ঐ মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে উঠালো, তখন আমার পেটে ওর দুই মাসের বাচ্চা৷ কি আর করার ছিল, নিজের হাতে স্বামীর বাসর সাজিয়ে দিলাম অন্য নারীর জন্য৷ এরপর আর কি, কাজের লোকের মত খাটাখাটনি করেও সেখানে টিকতে পারলাম না৷ শত নির্জাতন সহ্য করতে না পেরে নানুর কাছে ফিরে আসলাম, পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা৷ কিছুদিনের মধ্যই অসুস্থ হয়ে পড়লাম, বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না৷ তারপর আর স্বামীর কাছে যাইনি, থেকে গেলাম৷

কথাগুলো মৃনালিনী যতটা সহজভাবে বলছিল ততটা সহজ না৷ আমি জানি, ও ভেতরে ভেতরে কতটা কষ্ট পাচ্ছিল৷ আমি ওর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়া দুঃখগুলো অনুধাবন করছিলাম, ও বলেই চলছিল. . .
-আমার জন্য টেনশনে বেহাল অবস্থায় নানু আমাকে ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমালো, টানাপোড়ার সংসার থেকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মা আমার নানুর কাছে আসমানে চলে গেল৷ আমি হয়ে গেলাম চির একা৷ যে আমি একাকিত্ব সহ্য করতে পারতাম না সেই আমিই হলাম চির একা৷ মাঝে মাঝে চন্দন, অন্তুদের ফোন করতাম, ওরা ততদিনে ব্যস্ত জীবনে, ওদের যতদিন আমার প্রতি চাহিদা ছিল ততদিন আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল৷

আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, হয়তো এটা ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী হলে ওর মুখটা আমার অপ্রশস্ত বুকে চেপে ধরে খুব কাঁদতাম৷ কিন্তু এতদিনে সে কান্না শুকিয়ে গেছে, চাইলেও কাঁদতে পারি না, নিরবে শুনে যাচ্ছি. . .
-সবকিছুকে মেনে নিতে পারলেও নিজের বাচার সামান্য চাহিদার যোগান দিতে পারছিলাম না৷ তাই একদিন যে দেহ নিজের আনন্দের জন্য বিনা পয়সায় বিলিয়েছি সেই দেহ বাধ্য হয়ে পয়সায় বিলাতে শুরু করলাম৷ প্রথম প্রথম অনেকেই আসতো, যারা একবার আসতো তারা বার বার আসতো, আমাকে খুবলে খেত৷ তুমি রাগে, ঘৃনায় আমাকে পতিতা বলতে, আর ভাগ্য আমাকে সত্যিই পতিতা বানিয়েছিল৷ বয়সের ছাপ যত বাড়ছে ততই লোকের সমাগম কমে যাচ্ছে, আমিতো আর এখন সেই উনিশে নয়৷

আমার মনে হচ্ছে আমি কোন ঘোরের মধ্যে আছি, ওর কথায় আমার চমক ভাঙল. . .
-এই দেখ, আমি গল্প করেই যাচ্ছি৷ তুমিও তো আর সবার মতই আমাকে খরিদ করেছ, আমার গল্প শুনতে থাকলে তোমার পয়সা বিফলে যাবে!

আমার কিছু বলার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আমি ঘাবড়ে গেছি ভেবে আমাকে জিজ্ঞাস করল. . .
-তারপর, তোমার কি খবর?

আমি খানিকটা হচকিয়ে নিরবে বলতে থাকলাম. . .
-ভবঘুরে জীবনে বিয়েটা করা হয়ে ওঠেনি৷ তোমরা জেলে পাঠালে, দুইমাস সেখানে ছিলাম৷ জেল থেকে বেরিয়ে সব কিছু কেমন বিস্বাদ লাগে, পড়ালেখাতো সেই কবেই শিকায় তুলেছিলাম৷ পরিবারে এতদিনেও মুখ দেখায়নি, কোনমতে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করে অনেকদিন দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি৷ শেষমেষ গতবছর একটা হাইস্কুলে ঠায় হলো, নিজের বেখেয়ালিপনার জন্য ভাগ্য সেখানেও টিকলো না. . .
এইতো. . . ঘুরিফিরি, যেখানে রাত সেখানেই কাত টাইপের!

বলতে বলতে আমি মৃনালীনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, মনে হলো সেই উনিশে মৃনা আমার সামনে৷ আমার ঘোর কাটাতে মৃনালীনি আমাকে জিজ্ঞাস করল,
-চা খাবা?

চায়ের কাপ হাতে মুখোমুখি কেটে গেল অনেক সময়, ততক্ষনে ফজরের আজান পড়েছে. . .
প্রকৃতির নিরাবতা ভাঙতে শুরু করেছে, বুঝলাম আমার নিরাবতাও ভেঙেছে!
মনে হলো বলেই ফেলি, মৃনা কি-ই বা চেয়েছিলাম তোমার কাছে? তোমাকে ভালবাসতে চাইনি, তুমি বাসালে, ভালবাসলাম! চেয়েছিলাম তোমার ভেতর গড়া নোংরামীগুলো দূর হউক, তোমার দেহ-মন সবার না হয়ে আমার হউক৷ তুমি সেদিন যৌবনের বড়াইয়ে নিজেকে বিলিয়ে বেড়িয়েছ, বন্ধু-বান্ধবের সাথেও নিজের শরীর নিয়ে খেলতে দ্বিধাবোধ করোনি, এগুলোকেই জীবন মনে করেছ৷ আমি তোমাকে যখন বাধা দিলাম আমাকে তেয়াক্কা করলে না, যখন মানতে বাধ্য করতে চেষ্টা করলাম তখন আমার সাথে গড়া ভালবাসার সম্পর্ক নষ্ট করলে৷ যখন জোরপুর্বক তোমাকে নোংরামী থেকে দুরে থাকতে বললাম তখন কিছু মানুষের সমর্থনে আমার সাথে সবচেয়ে বড় দুর্ব্যবহার করলে, লোকজনের উসকানিতে পরিবারকে মিথ্যা বুঝিয়ে মিথ্যা মামলায় আমাকে জেলে পাঠালে!
আজ কই সেই কামনায় ভরা বন্ধুগুলো?
আজ তোমার সেই ভরা যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করেছে, চেহারার লাবন্যতা কমে এসেছে, কামনায় ভরা বন্ধুগুলো দুর থেকে দুরে সরে গেছে, তুমি একা হয়েছ৷ কোথায় তোমার সেই যৌবনের অহংকার?
সবই কন্ঠনালী পর্যন্ত এসে ফিরে যাচ্ছে৷ তোমার দেওয়া ব্যাথা অপেক্ষা তোমার পাওয়া পরিনতি আমাকে নিরব করে তুলছে৷

খানিক চুপ থেকে নিরবে উঠে দাড়ালাম, তোমার কাধ থেকে শাড়ির আচলটা নামালাম৷ তোমার বুকের খাজে নাক রেখে সেই উনিশে ঘ্রান নিতে চেষ্টা করলাম, অতঃপর ঠোট ছুয়ে দিলাম৷ আসার আগে তিনটা মোড়ানো এক'শ টাকার নোট হাতে গুজে দিয়ে আসলাম. . .
ভাবলাম, মৃনা'র বুকের সেই ঘ্রান এখন আর আমাকে আকৃষ্ট করে না!

তখন প্রায় ভোর, মৃনালিনী'র বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠলাম! ব্যাস্ত মানুষগুলো কাজের তাগিদে বের হয়েছে, পাখিদের কিচিরমিচির আমাকে ভাল লাগাচ্ছে না৷ আমি মৃনালীনিকে ভাবছি, মানুষ কি সত্যিই তার কর্মফল কিছুটা দুনিয়াতে পায়? আমি কি পারি না সব ভুলে মৃনালীনিকে গ্রহন করতে? সমাজ কি তা মেনে নেবে? আবার ভাবছি, কোথাকার সমাজ! ওকে নিয়ে এমন কোথাও চলে যাব যেখানে সমাজ বলে কিছু নেই৷ কিন্তু. . .

বুকের ভেতর পেচানো গোখরার মত ভালবাসা জেগে উঠেছে, আমাকে দংশন করছে, বিষ ঢেলে দিচ্ছে. . .
(সংক্ষেপিত)

লেখাঃ ঘাসফড়িং

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন